অহংকার থেকে মুক্তির উপায়

অহংকার থেকে মুক্তির উপায়

অহংকার বা গর্ব (আরবি: الكبر – কিবর) ইসলামি শিক্ষায় একটি মারাত্মক আত্মিক রোগ হিসেবে বিবেচিত। এটি মানুষকে সত্য প্রত্যাখ্যান ও অন্যদের তুচ্ছজ্ঞান করতে প্ররোচিত করে, যা আল্লাহ ও রাসুল (সা.) এর দৃষ্টিতে অত্যন্ত নিন্দনীয়। অহংকার থেকে মুক্তির জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায় নিম্নে আলোচনা করা হলো:


অহংকারের ভয়াবহতা অনুধাবন করা

কুরআন ও হাদিসে অহংকার সম্পর্কে কঠোর সতর্কবার্তা রয়েছে।

আল্লাহ বলেন:

"নিশ্চয়ই আল্লাহ অহংকারী ও আত্মগর্বীকে পছন্দ করেন না।"

(সূরা লুকমান ৩১:১৮)


রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

"যার অন্তরে সরিষা পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।"

(সহিহ মুসলিম: ৯১)

উপায়: অহংকার করলে সাথে সাথে আল্লাহর এই আয়াত ও হাদিস স্মরণ করুন। এটি আত্মশুদ্ধির জন্য খুব কার্যকর।

নিজের অস্তিত্ব ও সীমাবদ্ধতা চিন্তা করা

আমরা আল্লাহর সৃষ্টি, যার ক্ষমতা, জ্ঞান ও কুদরতের সামনে আমাদের কিছুই নেই।

আমরা মাটির তৈরি, এবং আমাদের শেষ ঠিকানা কবর, যেখানে অহংকারের কোনো মূল্য নেই।

আল্লাহ বলেন:

"তোমরা তো ধুলা থেকে সৃষ্টি হয়েছো, তারপর শুক্রবিন্দু থেকে, তারপর জমাট রক্ত থেকে..."

(সূরা হাজ্জ ২২:৫)

উপায়: প্রতিদিন কবর, মৃত্যুর কথা চিন্তা করলে অহংকার কমে যাবে।


আল্লাহর কাছে দোয়া করা

অহংকার থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর কাছে দোয়া করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাসুলুল্লাহ (সা.) অহংকার থেকে মুক্তি পেতে দোয়া করতেন।

দোয়া:

اللهم إني أعوذ بك من الكبر والعجب والرياء

উচ্চারণ: "আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযু বিকা মিনাল কিবরি ওয়াল উজবি ওয়াল রিয়া"।

অর্থ: "হে আল্লাহ! আমি অহংকার, আত্মগরিমা ও দেখানোর প্রবণতা থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই।"

উপায়: প্রতিদিন এই দোয়া পড়া অভ্যাস করুন।

বিনয়ী ও নম্র হওয়া

বিনয়ী মানুষদের আল্লাহ ভালোবাসেন এবং তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।

রাসুল (সা.) নিজে বিনয়ের সর্বোত্তম উদাহরণ ছিলেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

"আল্লাহ যার প্রতি অনুগ্রহ করেন, তিনি বিনয়ী হন এবং যার প্রতি অভিশাপ দেন, তিনি অহংকারী হন।"

(সুনান আবু দাউদ: ৪০৯৮)

উপায়: মানুষের সাথে কথা বলার সময় বিনয় দেখান, ছোটদের স্নেহ করুন এবং বড়দের সম্মান করুন।


গরিব ও অসহায়দের সাথে মিশুন

অহংকার কমানোর জন্য দরিদ্র, এতিম ও সাধারণ মানুষের সাথে মেশা এবং তাদের সেবা করা অত্যন্ত কার্যকর।

রাসুল (সা.) সবসময় দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের সাথে বসতেন এবং খেতেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

"দরিদ্রদের ভালোবাসো এবং তাদের সাথে মিশো, তাহলে তোমার অন্তরে নম্রতা আসবে।"

(মুসনাদ আহমাদ: ২৩৪২০)

উপায়: গরিব ও অসহায় মানুষদের সাহায্য করুন এবং অহংকার কমানোর জন্য তাদের সাথে সময় কাটান।

ক্ষমাশীল হওয়া ও অন্যদের সম্মান করা

অহংকারী মানুষ সাধারণত অন্যদের ছোট করে দেখে, তাই অহংকার থেকে বাঁচতে সবার প্রতি সম্মান দেখানো উচিত।

ক্ষমা করা ও নম্রতা প্রকাশ করা অহংকার কমায়।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

"সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি সেই, যে রাগের সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারে।"

(সহিহ বুখারি: ৬১১৪)

উপায়: যদি কেউ অন্যায় করে, তবে তাকে ক্ষমা করুন এবং নম্র আচরণ করুন।


অহংকারের বদলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা

অহংকার থেকে বাঁচতে কৃতজ্ঞতা (শুকরিয়া) একটি কার্যকর পদ্ধতি।

অহংকার আসে যখন আমরা নিজেদের অর্জনকে নিজের যোগ্যতা ভাবি, কিন্তু আমরা যদি বুঝতে পারি যে সবকিছুই আল্লাহর দান, তাহলে অহংকার আসবে না।

আল্লাহ বলেন:

"যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের প্রতি আরও অনুগ্রহ করব।"

(সূরা ইবরাহিম ১৪:৭)

উপায়: প্রতিদিন আল্লাহর নেয়ামতগুলোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন।

অহংকারীদের কষ্টদায়ক পরিণতি স্মরণ করা

অহংকার মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।

ইবলিস (শয়তান) অহংকারের কারণেই আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

আল্লাহ বলেন:

"আমি তাকে (ইবলিসকে) বলেছিলাম, আদমকে সিজদা করো, কিন্তু সে অহংকার করল এবং কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হলো।"

(সূরা বাকারা ২:৩৪)

উপায়: অহংকার করলে ইবলিসের পরিণতি স্মরণ করুন এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান।

অহংকার নয়, অন্যদের প্রশংসা করা শিখুন

অহংকার থেকে বাঁচতে নিজের সফলতা নয়, বরং অন্যদের সফলতার প্রশংসা করা দরকার।

রাসুল (সা.) সাহাবীদের প্রশংসা করতেন, যা তাদের বিনয়ী হতে সাহায্য করত।

উপায়: যখনই মনে হয় যে নিজের অর্জন নিয়ে অহংকার হচ্ছে, তখন অন্যদের প্রশংসা করুন এবং তাদের সাফল্যের জন্য দোয়া করুন।


ধৈর্যশীল ও সহজ-সরল জীবনযাপন করা

অহংকার কমানোর জন্য অতিরিক্ত বিলাসিতা ও অহংকারপূর্ণ জীবনযাপন পরিহার করা দরকার।

রাসুলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন।

তিনি বলেছেন:

"এই দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, তাই এতে অহংকার করার কিছুই নেই।"

(তিরমিজি: ২৩৭৭)

উপায়: সাধারণ জীবনযাপন করুন, অহংকারবশত ব্যয় করা থেকে বিরত থাকুন।


অহংকার শব্দের অর্থ কি?

অহংকার (দাম্ভিকতা বা ঔদ্ধত্যও বলা হয়ে থাকে) বলতে বোঝায় অতিমাত্রায় গর্ব করা বা নিজেকে চরমভাবে অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান করার আচরণ। আরও সুস্পষ্টভাবে, এটি হল বাস্তবতার সাথে সম্পর্কহীনতা আর নিজের প্রতিদ্ধন্দিতা বা সক্ষমতাকে অতিমূল্যায়ন করা।


অহংকার সম্পর্কে ইসলাম কি বলে?

পবিত্র কুরআন অনুসারে, অহংকার এমন একটি পাপ যার শাস্তি নিশ্চিতভাবেই কঠোর হবে । সর্বশক্তিমান আল্লাহ সূরা আয-যুমারে বলেন: "অহংকারীদের জন্য কি জাহান্নামে কোন আবাসস্থল নেই?" (সূরা আয-যুমার ৩৯:৬০)। কিয়ামতের দিন তুমি তাদের মুখ কালো দেখতে পাবে যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে।


মানুষ অহংকারী হয় কেন?

কিছু সাধারণ কারণ হল:

আত্ম-সম্মান: অহংকার প্রায়ই আত্ম-সম্মান বা আত্মসম্মানবোধের সাথে যুক্ত। 

অভিজ্ঞতা: সাফল্য বা অর্জনের অভিজ্ঞতা অহংকারকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। 

প্রতিযোগিতা: প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ অহংকারকে উত্সাহিত করতে পারে। 

সমাজীকরন: অহংকার সামাজিকীকরণের মাধ্যমে শিখতে পারে।


অহংকারী ইংরেজিতে কি?

অহংকারী , অহঙ্কারী /adjective/ Proud ; conceited ; vain ; arrogant.


অহংকার সম্পর্কে কুরআন কি বলে?

"আর মানুষের সামনে নাক উঁচু করো না, আর পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অহংকারী, অহংকারীকে পছন্দ করেন না।"


উপসংহার

অহংকার একটি ভয়াবহ আত্মিক রোগ, যা মানুষকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। তবে কিছু কার্যকর উপায় অনুসরণ করলে এটি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব:

(১) কুরআন ও হাদিসের আয়াতগুলো স্মরণ করা।

(২) মৃত্যু ও কবরের কথা চিন্তা করা।

(৩) অহংকার থেকে বাঁচতে দোয়া করা।

(৪) বিনয়ী হওয়া ও সাধারণ মানুষের সাথে মেশা।

(৫) ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞ হওয়া।

যদি কেউ অহংকারবশত কাজ করে, সাথে সাথে তওবা করা উচিত। আল্লাহ তাআলা সকলকে অহংকার থেকে মুক্তি দান করুন, আমিন।